নাইম আইটি https://www.nayemit.com/2022/01/moon.html

চাঁদের উল্টো পিঠের রহস্য

সৌরজগতের শুরুর দিকে চাঁদ এখনকার চেয়ে পৃথিবীর আরো অনেক কাছাকাছি ছিল; আর আজকের মতো এমন কঠিনও হয়ে ওঠেনি। তখন চাঁদ নিজের অক্ষের ওপর এখনকার চেয়ে আরো জোরে ঘুরপাক খেত; কিন্তু তার যেদিকটা পৃথিবীর মুখো হত সেদিক পৃথিবীর আকর্ষণের টানে জোয়ারের মতো ফুলে উঠত─ এই ফুলে ওঠা তার ঘোরায় বাধার সৃষ্টি করত। এভাবে চাঁদের ঘোরার বেগ কমতে কমতে এক সময় পৃথিবীর তুলনায় ঘোরা একেবারে থেমে গেল; যেটুকু ঘোরা থাকল তা শুধু পৃথিবীর চারপাশে ঘোরার সমান। ধরা যাক কেউ ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ার বসিয়ে তার দিকে মুখ রেখে চারপাশে ঘুরছে; চেয়ারটাতে কেউ বসে থাকলে সে শুধু প্রথম জনের মুখই দেখতে পাবে, পেছন দিক কখনো দেখবে না। ব্যাপারটা অনেকটা তেমনি।
moon mystery
এ থেকে মনে হতে পারে আমরা বুঝি সব সময় চাঁদের গায়ের ঠিক অর্ধেক এলাকা দেখতে পাই। কোন এক সময়ে ৫০ শতাংশ দেখতে পেলেও আজ আমরা মোটমাট দেখি চাঁদের ৫৯ শতাংশ এলাকা। আসলে চাঁদ নিজের অক্ষের ওপর সর্বক্ষণ একই বেগে ঘুরলেও পৃথিবীর চারপাশে সব সময় একই বেগে ছোটে না। তার কারণ পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের পথটা পুরোপুরি গোল নয়, অনেকটা উপবৃত্তের মতো। চাঁদ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসে তখন পৃথিবী থেকে দূরত্ব হয় ৩৫৬,৪০০ কিলোমিটার (অনুভূ) আর যখন সবচেয়ে দূরে থাকে তখন দূরত্ব হয় ৪০৬,৭০০ কিলোমিটার (অপভূ)। আর চাঁদ পৃথিবীর কাছে এলে তার ঘোরার বেগ হয় বেশি, দূরে থাকলে ঘোরার বেগ হয় কম। এতে নিজের অক্ষের ওপর ঘোরা আর কক্ষপথে তার অবস্থানে কিছুটা গরমিল হয়; এজন্য মনে হয় চাঁদ যেন সামান্য দুলছে। প্রথমে পুবদিকে তার গা একটু বেশি দেখা যায়, তারপর পশ্চিম দিকে একটু বেশি দেখা যায়। তাছাড়া চাঁদের বিষুবতল কক্ষপথের সঙ্গে সামান্য কোণ (৬০) করে আছে; এজন্য উত্তর-দক্ষিণেও তার সামান্য দুলুনি হয়। সবটা মিলিয়ে চাঁদের ৪১ শতাংশ এলাকা সব সময় আমাদের চোখের আড়ালে থাকে।

দৃশ্যটা অবশ্য হঠাৎ করে বদলে গেল ১৯৫৯ সালের অক্টোবরে। রাশিয়ার লুনা-৩ নভোযান চাঁদের উল্টো পিঠের ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠাল। এই প্রথম মানুষ জানতে পেল চাঁদের রহস্যময় উল্টো পিঠের খবর। দেখা গেল সচরাচর চাঁদের যে পিঠ আমরা দেখতে পাই উল্টো পিঠটা অনেকটা সেরকমই। অবশ্য তার পর আরো নভোযান বিশেষ করে অ্যাপলো নভোযান থেকে চাঁদের উল্টো পিঠের অনেক স্পষ্ট ছবি তুলে সে পিঠ সম্বন্ধে বহু নতুন খবর জানা গিয়েছে। চাঁদ পৃথিবীর দিকে সব সময় মাত্র একটা পিঠ ঘুরিয়ে থাকলেও সূর্যের দিকে কিন্তু দু’পিঠই মেলে দেয়, তাই সারাটা চাঁদে দিন-রাত হয় একই ধরনের। তবে এই উল্টো পিঠ থেকে পৃথিবী কখনো দেখতে পাওয়া যায় না।

চাঁদের এক পিঠ যে সব সময় পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে তার ফলে তার এক দিকে দু’সপ্তাহ ধরে থাকে সূর্যের আলো, তখন অন্য পিঠ থাকে অন্ধকারে; তারপর আবার দু’সপ্তাহ ধরে হয় এর উল্টো অবস্থা। চাঁদের যে পিঠে সূর্যের আলো থাকে সে পিঠে তাপমাত্রা ওঠে ১২৭ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত আর অন্য পিঠে তাপমাত্রা নেমে যায় ১৭৩ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত। নভোযানে চাঁদের পথে

আজ প্রায় চার দশক হল মানুষ মহাকাশে নভোযান পাঠাতে শুরু করেছে। নভোযানে করে মানুষ চাঁদে গিয়ে পৌঁছেছে তাও প্রায় তিন দশক হল। আজকাল মহাকাশে নভোযান পাঠানো যেন রোজকার সাধারণ একটা ব্যাপার হয়ে উঠেছে; কিন্তু আসলে ব্যাপারটা রীতিমতো জটিল। মহাকাশে যেতে হলে যেতে হবে রকেটের সাহায্যে; কিন্তু একই রকেটে চাঁদে যাওয়া আবার তাতে চেপে ফেরত আসার কোন উপায় আজও বের করা যায় নি। যাওয়া যায় পর পর কয়েকটি রকেট জোড়া লাগিয়ে; ফেরার কায়দাও তেমনি জটিল। 

অ্যাপলো নভোযানে বসতে পারে তিনজন নভশ্চর। নভোযানটিকে শক্তিশালী তিন-স্তর রকেটের সাহায্যে ছোঁড়া হয় চাঁদের দিকে; চাঁদের কাছাকাছি পৌঁছে সেটা চাঁদের চারপাশের কক্ষপথে ঘুরপাক খেতে থাকে। তারপর তা থেকে দু’জন নভশ্চর চন্দ্রফেরিতে করে চাঁদের ওপর আলতোভাবে নেমে আসে। যখন ফেরার সময় হয় তখন এই চন্দ্রফেরিই আবার নিচের দিকে রকেট ইঞ্জিন ছুঁড়ে চাঁদ থেকে ওপরে উঠে মূলযানের কক্ষপথে তার সঙ্গে জোড়া লাগে। নভশ্চর দু’জন ঢুকে যায় মূল্যযানে, তারপর নভোযান আবার ফেরত আসে পৃথিবীতে। এই ব্যবস্থার একটা অসুবিধে হল চন্দ্রফেরি যদি ঠিকমতো ওপরে উঠতে না পারে তাহলে সেই নভশ্চরদের উদ্ধার করার আর কোন উপায় নেই।

প্রথমবার চাঁদে নামার আগে দুটো মহড়া হয়ে গেল। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসে অ্যাপলো-৮ ঘুরে আসে চাঁদের চারপাশ দিয়ে; ১৯৬৯-এর মে মাসে অ্যাপলো ১০-কে পরীক্ষা করা হয় একেবারে চাঁদের কাছে নামিয়ে দিয়ে, তারপর আবার সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই তারিখে গ্রিনিচ মান সময় ২০:১৮ মিনিটে (ঢাকা সময় ২১ জুলাই সকাল ২:১৮) অ্যাপলো-১১ নভোযানের চন্দ্রফেরি নামল চাঁদের বুকে। প্রথমে নভশ্চর নীল আর্মস্ট্রং (Neil Armstrong) নেমে এলেন চাঁদের ‘মারে ট্রাংকুইলিটাটিস’ বা প্রশান্তির সাগরে। চাঁদের মাটিতে এক পা এগিয়ে গিয়ে তিনি উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন, “একজন মানুষের জন্য ছোট একটি ধাপ; কিন্তু মানব জাতির জন্য বিশাল এক লাফ।” একটু পরে নেমে এলেন এডুইন অলড্রিন (Edwin Aldrin)। পরে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন সেখানে ধুলো আর মাটি আছে প্রায় ২০ মিটার (৬০ ফুট) পুরু; তার তলায় আছে কঠিন পাথর।

দু’জনে মিলে চাঁদের মাটিতে দু’ঘণ্টার কিছু বেশি সময় হাঁটাচলা করলেন। তাঁদের প্রথম কাজ ছিল চাঁদের মাটি-পাথরের নমুনা সংগ্রহ করা─ তাঁরা সেখান থেকে প্রায় ২০ কেজি (৪৮ পাউণ্ড) নমুনা সংগ্রহ করলেন; তারপর কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার যন্ত্রপাতি বসালেন। চাঁদে কোন হাওয়া নেই; তাই তাঁদের পরতে হয়েছিল নভশ্চরের জবড়জঙ গোছের বিশেষ ধরনের পোশাক। তার ওপর চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ বল পৃথিবীর তুলনায় মাত্র ছ’ভাগের একভাগ। তাই শরীরের ভারসাম্য রাখার জন্য তাঁদের চলাফেরা করতে হচ্ছিল বেশ ধীরে ধীরে। সারা পৃথিবীর লোকে ঘরে বসে টেলিভিশনে তখন আর্মস্ট্রং আর অলড্রিনের হাঁটাচলা দেখতে পায়।

চাঁদ থেকে নভশ্চররা বেশ কিছু মাটি-পাথরের নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন; পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা যেসব পরীক্ষা করে দেখলেন পৃথিবীতে যে ধরনের আগ্নেয়শিলা দেখা যায় সেগুলো প্রায় হুবহু তেমনি। তাই তা থেকে তেমন কোন নতুন খবর মিলল না। দেখা গেল শিলার বয়স প্রায় ৩০০ কোটি বছর; পরে জানা গিয়েছে চাঁদের বেশিরভাগ শিলার বয়সই এর চেয়ে বেশি। শিলা থেকে চাঁদের ওপর পানি বা প্রাণের কোন লক্ষণ খুঁজে পাওয়া গেল না; এমন কি আদিকালের কোন রকম জীবনের ফসিলও না। তবু অজানা জীবাণু সংক্রমণের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পুরো পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নভশ্চরদের আড়াই সপ্তাহ ধরে পৃথক করে রাখা হল।

শেয়ার করলে মিষ্টি পাবেন

0 জন কমেন্ট করেছেন

Please read our Comment Policy before commenting. ??

পটেনশিয়াল আইটি কী?